মায়াজাল (পর্ব ০৩)


০৫!!

বিয়ে পড়ানোর সময় বেলার মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে। তিন বারই 'কবুল' শব্দটা বলতে গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। কাঁপা হাতেই রেজিস্ট্রিতে সাইন করে আবীরের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো আবীরের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলা করছে। লোকটা কেন হাসছে কিছুই বুঝতে পারলো না বেলা৷

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সবাই চলে গেল যার যার বাসায়। বাড়িটা খালি হতে বেশ রাতই হয়েছে। এখন বাড়িতে শুধু আবীর, বেলা, বেলার মা আর কাজের লোকেরা। সায়েরা আর কাজের লোকেরা বেলাকে রুমে বসিয়ে যে যার রুমে চলে গেল। বেলাও রুমটা দেখছে ভালো করে। ফুলের সাজ নেই রুমে। তবুও অদ্ভুত সুন্দর করে সাজানো রুমটা। খাটের স্ট্যান্টগুলোয় ফিনফিনে পর্দার মতো কাপড় বাঁধা। এগুলো কিসের কিছুই বুঝতে পারছে না বেলা। বিছানা থেকে সামনে তাকালেই বিশাল জানালা। জানালার ওপাশে বারান্দার উপরের দিকটা ফাঁকা। আর বিশাল বারান্দাটায় একটা মাঝারি কাউচ দেয়া। সামনে ছোট্ট একটা টি টেবিল রাখা। টবে কয়েকটা ফুল গাছ থাকলেও বাকি জায়গাটাই ফাঁকা। বেলা আপন মনে প্ল্যানিং করছে আর কি কি লাগবে বারান্দাটা গোছাতে। 

এর মধ্যেই কারো উষ্ণ হাতের স্পর্শ টের পেল বেলা। মানুষটা কোমড় পেঁচিয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখেছে পিছন থেকে।

-আমাকে জ্বালাতন করে এখন বারান্দায় এসে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছো?

-তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?

-বউকে আদর দিতে গেলাম। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল---।

বেলা আবীরের হাত ছাড়িয়ে আবীরের দিকে ঘুরতেই আবীর আবার বেলাকে জড়িয়ে ধরলো। বেলা চোখ গরম করে আবীরের দিকে তাকালো। আবীর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বেলাকে দেখছে। এখন কেমন লাগে দেখো!

-ওই? কি বললা তুমি? তুমি বউ কোথায় পেলে? তোমার বউ তো আমি?

-কি বলো! তুমি জানো না? তুমি তো পাত্তাই দিচ্ছিলা না। তাই ১ সপ্তাহ হয় বিয়ে করেছি--। বউ অনেক ভালো জানো? তোমাকে বিয়ে করবো বলসি--। একটুও রাগ করে নি--। আর তুমি কিনা!

-তুমি! আজাইরা কথা বলার মানুষ খুঁজে পাও না তাই না? তুমি তো চব্বিশ ঘন্টার ছাব্বিশ ঘন্টা আমার চারপাশে ঘুরঘুর করো৷ বিয়ে করলা কখন?

-চব্বিশ ঘন্টায় আবার ছাব্বিশ ঘন্টা হয় কেমনে গো বউ?

-যেমনেই হোক---৷ মিথ্যা বললা কেন তুমি খারাপ ছেলে? তোমার সাথে কথাই নাই আর--।

বেলা রাগ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে আসতেই আবীর বেলাকে কোলে তুলে নিয়েই কাউচে বসে পড়লো। বেলা রেগে গিয়ে নাচানাচি করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। এদিকে আবীর ওকে জাপটে ধরে আছে।

-এই যে মিসেস বেলা তাসমিহা আবীর চৌধুরী-। উঁহু নামটা বেশি বড় হয়ে গেল না? তো মিসেস বেলা আবীর চৌধুরী? আমাকে বলা কথাগুলো কি খুব সত্যি ছিল? আপনি নাকি অন্য কোন বিখ্যাত বিজনেস ম্যাগনেটকে বিয়ে করছেন?

-তুমি ওটা নিয়ে এখনো রাগ করে আছো? সরি তো?

-সরি মাই ফুট---। আমি কি করি তুমিও দেখো না--। একটুও ভালোবাসবো না। একটুও আদর দিবো না। একটুও ছুঁয়েও দেখবো না---। 

-তাই?

-হ্যাঁ তাই----।

-তো এখন কি করছো?

বেলা আবীরের গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আবীরও বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

-এটাই হলো সমস্যা--। বুঝলে? তোমার কাছে এলে রাগ করে থাকতে পারি না---। কিছুতেই পারি না রে তোর উপরে রেগে থাকতে-----।

-আর কখনো রাগ করতে দিবোও না আমি---।

বেলা আবীরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবীরও যেন সেই দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছে বারবার। নিজেকে সামলে নিয়ে বেলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েই রুমে চলে এলো আবীর। তারপর খাটে শুইয়ে দিয়ে স্ট্যান্ড থেকে পর্দাগুলো খুলে দিতে লাগলো। সবগুলো পর্দা মেলা হয়ে গেলে নিজেও বেলার পাশে এসে শুয়ে পড়লো।

-কি হলো এটা?

-কোনটা?

-আজকে আমাদের বাসর---।

-জানি।

-কথা কি ছিল?

-মনে নেই---।

-কি বললা? কথা ছিল তুমি আজকে সারা রাত বুকে জড়িয়ে ধরে গান শুনাবা আমাকে-----।

-সরি। পারছি না। আমি বহু টায়ার্ড---। গান শোনানোর সময় নেই-----। ঘুমাবো।

------------------------------

-কষ্ট হচ্ছে?

-হুম---। তুমি তো এমন না আবীর--। কেন করছো এমন?

-আমি কেমন সেটা তো জানো। তবুও তো বলেছিলে---।

-সরি তো? আর কখনো হবে না। ভুল হয়ে গেছে।

- চুপ করে ঘুমাও---। সকালে বাড়ি যাবো---। এখন কালকের জন্য মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড হও--।

বেলা মুখটা কালো করে রেখেছে দেখে আবীর বেলাকে হালকা করে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বাতাসে খাটে পর্দাগুলো কাঁপছে অনবরত। মন খারাপ করে সেটা অনুভব করতে করতেই ঘুমানোর চেষ্টা করলো বেলা। আর আবীর বেলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পরের একটা কঠিন সকালের অপেক্ষা করতে লাগলো।

বেলা মন খারাপ করেই আবীরের বুকে মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে। ঘুম কিছুতেই আসছে না। আজকের দিনটা তো সম্পূর্ণ অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল ফুলে ফুলে সাজানো বাসরে বেলা ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। আবীর আসতে দেরি করেছে বলে রাগ করে মুখ তুলে তাকাবেই না ওর দিকে বেলা। আর প্রেয়সীর রাগ ভাঙাতে অঞ্জন দার 'বেলাবোস' ছাড়া পৃথিবীর যে কোন গান শোনাবে আবীর। সেই মাতাল করা গানের শব্দে কেঁপে উঠে শক্ত করে আবীররে পাঞ্জাবি খামচে ধরবে বেলা। 

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বেলার চোখ দিয়ে টিপ টিপ করে পানি ঝড়ছে বেলার। আবীরের রাগ করে থাকাটাও যৌক্তিক-তাই ওকে দোষও দেয়া যাচ্ছে না। এসব ভাবছে এমন সময় কানে আবীরের ঠোঁটের স্পর্শ পেল বেলা। আর গানের কিছু লাইন ভেসে এলো আবীরের কণ্ঠে।

-"Chaand mera naraaz hai
Na baat kare na milta hai
Kaise usko samjhaun
Na samjhe rishta dil ka hai

Hafton se kitne
Usne na baat ki
Mujh ko pata bhi nahi
Kis baat ki naraazgi

Chand mera naraz hai
Na baat kare na milta hai
Kaise usko samjhaun
Na samjhe rishta dil ka hai

Bheed hai itni duniya me par
Koi na apna dikhta hai
Log hai pagal kya samjhe jo
Tera mera rishta hai

Tujhko bhi toh hai na mohabbat
Phir kyun doori rakhta hai

Na shab mein na subah mein
Na shaam dhale woh milta hai
Kaise usko samjhaun
Na samjhe rishta dil ka hai

Rasme aise duniya ki hai
Jinse dil yeh darta hai
Dil bebas hai milna chahe
Ye rota hai tadapta hai

Dil marr sakta hai toh tere bin
Par ab jee nahi sakta hai

Tere bin beete jo pal
Har pal lagta mushkil sa hai
Mujhko baat pata hai yeh
Main sochun rishta dil ka

Hafton se kitne
Usne na baat ki
Mujh ko pata bhi nahi
Kis baat ki naraazgi

Chaand mera naraaz hai
Na baat kare na milta hai
Kaise usko samjhaun
Na samjhe rishta dil ka hai."

বেলা মুখ তুলে আবীরের দিকে তাকাতেই আবীর বেলার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো। অনেকক্ষণ পর আবীর মুখ তুললেও বেলা লজ্জায় চোখ খুলতে পারছিল না। বেলার লাল লজ্জারাঙা মুখটা দুহাতে তুলে চোখে চোখ রাখলো আবীর।

-তোমায় না ভালোবেসে-না আদর দিয়ে-না ছুঁয়ে থাকা এক্কেবারে অসম্ভব বেলা---। যাই হয়ে যাক না কেন বেলা-আমাকে অন্তত একবার শেয়ার করো? প্লিজ? তোমাকে ছাড়া বাঁচা যে আমার পক্ষে সম্ভবই না----।

বেলা আবীরের বুকে মুখ লুকিয়ে জড়িয়ে ধরলো আবীরকে।

-সরি? মাফ করে দাও এবারের মতো? আর হবে না কখনো----।

-উউউউউমমম। মাফ করতে পারি এক শর্তে--।

-কি?

-পাগলের মতো ভালোবাসা দিবা--। আর আমাকেও পাগলের মতো ভালোবাসতে দিবা---। ডান?

বেলা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নেয়ার আগে বেলা মুখটা আবার দুহাতে ধরে রইলো।

-কি হলো? বলো বলো?

-অসভ্য লোকটা-----।

-আচ্ছা? আমি অসভ্য? তো অসভ্য লোকের অসভ্যতামোও দেখো----।

আবীরের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসায় গা এলিয়ে রাতটা কাটলো বেলার। সকালে ঘুম ছুটতেই দেখলো আবীর ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বেলার উপরেই শুয়ে আছে। আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো বেলা৷ সারা রাত জ্বালাতন করে এখন নিজে শান্তিতে ঘুমানো হচ্ছে? কথাটা মাথায় আসতেই লজ্জা পেয়ে আবীরের মুখের দিকে তাকালো বেলা। মানুষটার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা ফিরে এসেছে আবার। আর মুখের সেই প্রশান্তি। 

আবীরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাত ছাড়িয়ে খাট থেকে নামতেই আবার হাতে টান খেয়ে আবীরের উপরে এসে পড়লো বেলা। আবীরও দেরি না করে বেলাকে বুকে টেনে নিলো।

-উফ---। এই? কি করছো?

-শুধু কপালে আদর দিয়ে কই যাও?

-ভারি খারাপ হয়ে গেছ তুমি---। ছাড়ো----। শাওয়ার নিবো---। 

-বিরক্ত করো না তো---। ঘুমাতে দাও---। একটু আগেই চোখটা লেগে এসেছিল----।

-এর আগে কি করেছো? চুরি করেছো?

কথাটা বলেই নিজের জিভ কাটলো বেলা। আবীরের বাঁধন থেকে ছোটার চেষ্টা করতে লাগলো।

-আরে? কি করেছি জানো না? আবার করে দেখাবো?

-অসভ্য লোকটা---। সরো--। আমি ফ্রেশ হবো---।

-তো--যাও--। ফ্রেশ হও--। যাও--আমার বুকের মধ্যে ডুব দিয়ে শুয়ে না থেকে----।

-ছাড়ো তাহলে?

-আমি ছাড়ব কেন? নিজে যাও---।

-আহ-----হা-----।।

-হা হা---। না যেতে পারলে চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি ঘুমাই। তুমি চাইলে ঘুমাও। নইলে জেগে জেগে আমাকে দেখো---।

-সরো-----।

-আর একবার ডিস্টার্ব করবা বেলা তো খবর আছে তোমার----।

-বললাম তো ছাড়ো----?

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবীর বেলার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো।

-মিসেস বেলা আবীর চৌধুরী --। আজীবন এভাবে জব্দ হওয়ার জন্য রেডি থাকুন-----।

-ধ্যাত-------।

বেলা আবীরের বুকে মুখ লুকিয়ে ভাবতে লাগলো। এই লোকটার সাথে কিছুতেই পেরে ওঠে না ও। ওই বাড়িতে গেলে যে কি হবে সেটা ভাবতেই পাগল পাগল লাগছে বেলার। আর এদিকে আবীরের উষ্ণ স্পর্শে দু চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। শান্তির ঘুম।

০৬!!

ঘুম ভাঙতেই বেলা দেখলো আবীরের বুকে মাথা রাখা। আবীর ওকে দু হাতে জাপটে ধরে আছে শক্ত করে। আবীরের হাত ছাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বেলা আবীরকে জাগিয়ে দিল। দু জনে মাতলো ভালোবাসার খুনসুটিতে। সারাদিন দুষ্টুমিতে কাটলো ওদের। 

সন্ধ্যায় চৌধুরী ম্যানশনে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে বেলা। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে ওর। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর কি হবে সেটা ভাবতেই ভয় ভয় করছে বেলার। তবু রেডি হওয়ার মন দিল। টুকটুকে লাল একটু ভারি সুতার কাজ করা কাতান শাড়ি পড়েছে বেলা। শাড়ির সোনালী পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে সোনালী রঙা ব্লাইজ। মায়ের দেয়া গয়না পড়ে হালকা করে কাজল আর লিপস্টিক রাঙিয়ে সাজ সেরেছে বেলা। নিজেকে আয়নায় দেখছে এমন সময় আবীর এসে বেলাকে জড়িয়ে ধরলো। 

-ইশ! বউটাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে সারাদিন ধরে দেখি----।

------------------------------

-কি ভাবো বউটা?

-বাবা যদি----------?

-এতো ভেব না বেলা। বাবা আমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতেই পারে না। আর বিয়ে করেছি সেটা জানিয়েই করেছি-----।

-কি বলছো?

-হুম। গতকালই বাবাকে জানিয়ে এসেছিলাম যে তোমাকে বিয়ে করার কথাটা। বাবা রেগে গিয়ে-। তাই তো আমার পরী বউটাকে নিয়ে বাসায় ফিরছি---। কতোক্ষণই আর রাগ করে থাকবে?

-তবুও-------------।

-এতো চিন্তা করো না তো---। আর মা এ বাড়িতেই থাক। কি বলো?

-হুম----------------।

-আরে বাবা? এমন মুখ গোমড়া করে বসে থাকলে হবে? একটু হাসো তো?

বেলা আবীরের কথায় একটু হাসার চেষ্টা করল। আবীর বেলার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে লাল একটা পাথরের টিপ পড়িয়ে দিল কপালের মাঝ বরাবর। তারপর সায়েরাকে বলে গাড়ি নিয়ে বের হল।

কলিংবেল বাজতেই কেউ একজন দরজা খুলে দিল৷ বেলা মানুষটাকে চিনতে পারলো। আবীরের কেমন যেন ভাই হয়। নাম নিশান। আবীরকে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে আছে নিশান।

-মামা, মামি? আবীর ভাই ভাবিকে নিয়ে আসছে। দেখে যাও?

-ওই মেয়েকে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে যেতে বল নিশান। ওই মেয়ে এই বাড়ির ভেতরে পা ফেলবে না। 

আসাদ চৌধুরীর এমন কথায় ঘাবড়ে গিয়েই এক পা পিছিয়ে গেল বেলা। আবীর বেলার দিকে একবার চেয়ে নিজেও দাঁড়িয়ে গেল।

-বাবা? বেলার আর আমার গতকালই বিয়েটা হয়েছে। তোমাকে তো বলেছি-----।

-আমিও তোমাকে বলেছি আবীর--। এই মেয়েদের কাজই হল এইসব নোংরামি করা। বিয়ে-ডিবোর্স, সম্পত্তি-টাকা--। আর এসব না পেলে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে---। অন্য কারো সাথে----।
 
-বাবা? কি সব বলছো? সি ইজ মাই ওয়াইফ। আর বেলা এমন মেয়েই না--। জানি তোমার লোয়ার ক্লাস মানুষ পছন্দ না। কিন্তু তাই বলে সবাই তো এক না বাবা---। এক আধ জন খারাপ হতেই পারে-। কিন্তু বেলা মোটেও এমন নয়-----। একটাবার বেলাকে সুযোগ দাও না বাবা প্লিজ?

-খবরদার আমাকে বাবা বলে ডাকবে না আবীর---।

-কি বলছো বাবা? তুমিও জেনে রাখো বাবা----। বেলা যদি আমাদের সবার সাথে এই বাড়িতে থাকতে না পারে--তবে আমিও এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আজীবনের জন্য---। কখনো ফিরবো না---।

-আবীর------?

-মাইশা? দেখেছ রক্ত কেমন করে কথা বলে? ছোটলোকের রক্ত বইছে তো শরীরে--। সেটা তো প্রকাশ পাবেই। দেখো--। এতো চেষ্টা করে, কষ্ট করে, ভালোবাসা দিয়ে বড় করলাম-কিন্তু ঠিকই সেই ছোট লোকের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথাটা বলেই ফেললো। তাও এই বদ মেয়েটার জন্য------।

-বাবা? মা? বাবা এসব কি --কি বলছে এসব?

-খবরদার বাবা ডাকবি না আবীর। তুইও তোর বাপের মতো হয়েছিস--। যখন চার বছরের তোকে আর পেটে আরেকটা বাচ্চা নিয়ে তোর মায়ের পাশে থাকার কারো খুব দরকার ছিল-সেই সময়েই তোর বাপ চলে গেছে--। রাগ দেখিয়ে ঘর ছেড়েছে। তাও কি জন্য- প্রেগন্যান্ট ওয়াইফ তার বাবা মার জন্য কান্নাকাটি করছে এসব তোর স্ট্রাগলিং রাইটার বাপের সহ্য হয় নি তাই।---সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো কাকে বলে বুঝিস? এই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো তোর মায়ের--তার সেকেন্ড বেবিটা, তোর ছোট্ট বোনটা টাকার অভাবে, একটু খাবারের অভাবে মিসক্যারেজ হয়ে গেছে---। ভাবতে পারিস?? 

-বাবা!

-এই নিশানকে দেখছিস? ওর দাদুকে দেখতে হসপিটালে না গেলে সেদিন কি হতো জানিস!

------------------------------

-নিজে সাক্ষী হয়ে থেকে তোর বাবা আর মায়ের বিয়ে দিয়েছিলাম আমি৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু-আমার ছোটবেলার খেলার সাথীকে তোর বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। শুধু এই একটা বিয়ের জন্য মেয়েটার থেকে পরিবার নামের খুশিটাই চলে গিয়েছিল--। তবু তো সহ্য করেছিল--। আজও -----। আর তুই? বদ রক্তেরা সব সময় নিজের ক্ষমতা দেখিয়েই দেয়-তাকে যতই ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হোক না কেন---। আবীর তুই যা--। চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে-----।

-বাবা?

-খবরদার আমাকে আর কখনো বাবা বলে ডাকবি না। তোকে ছেলের মতো আগলে রাখার জন্য নিজের নাম দিয়েছিলাম-। সেই নামে অনেক বড় হয়েছিস। আর তো দরকার নেই আমাদেরকে----। তাই গিয়ে ছোটলোকগুলোর সাথে মিশেছিস---।

-তোমার নামে- তোমার পরিচয়ে বড় হয়েছি। তবে আজকের পর আর নিজের নামের পাশে তোমার নামটা লাগাবো না বাবা-----। মা? চলো? নিজের যোগ্যতায় মাথা উঁচু করে থাকবো তোমাকে নিয়ে--। কারো দয়ায় বেঁচে থাকতে হবে না।

-আবীর? যে মানুষটার দয়ায় থাকতে তোর আজ কষ্ট হচ্ছে-সেই লোকটার কারণে আমি মরতে মরতেও বেঁচেছি অনেকবার৷ তোর বাবার সাথে বিয়েটা হয়েছে তার জন্য। তোকে মানুষ করতে পেরেছি তার জন্য। এতোগুলো বছর এক বাড়িতে থেকেও আমি নিজেকে নিরাপদ বোধ করেছি তার জন্য। সবটা হারিয়ে লোকটা ক্লান্ত৷ তার পাশে আজ তার বেস্টফ্রেন্ডটাকে দরকার। তুই যা---। ভালো থাকিস। 

আবীর টলে পড়ে যাচ্ছিল দেখে বেলা আর নিশান ওকে ধরে সামলালো। আবীর কোনমতে টাল সামলে চোখ মুছে সামনে একবার তাকালো।

-মা গেলাম৷ চলি বাবা--। আশা করি আমার মতো ছোটলোকের মুখটা তোমাকে আর কখনো দেখতে হবে না। আর মাথাটাও নিচু হবে না। চলো বেলা?

আসাদ সাহেব চকিতে বেলার মুখের দিকে তাকালেন৷ আবীর আর বেলা হাত ধরেই ধীরে ধীরেই হাঁটতে হাঁটতেই বেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটাও নিয়ে যায় নি আবীর। আসাদ সাহেবের মনে হলো তার কলিজাটা কেউ ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।  তবুও তিনি টু শব্দটাও করলেন না। ওদেরকে থামানোর চেষ্টাটুকুও করলেন না একবারও।

সারাটা রাস্তা আবীর যেন ধ্যানের মধ্যে ছিল। কি হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কিছুই যেন টের পাচ্ছে না আবীর। গাড়িটা রেখেই চৌধুরী ম্যানশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর টলে টলে হাঁটছিল বেলার হাতটা ধরেই। এতোটা ধাক্কা খাবে সে বেচারা তো কখনো কল্পনাও করতে পারে নি। যে বাবা কখনো ওকে একটা ধমক পর্যন্ত দেন নি-তিনি আজ কত কথা শুনিয়ে দিলেন। তার চেয়েও বড় কথা সেই মানুষটা আবীরের বাবাও নয়! এতোগুলো বিষয় একসাথে ঘটায় আবীরের যেন কোন ইন্দ্রিয়ই কাজ করতে চাইছে না। 

পাঁচ মিনিটের বেশি সময় ধরে পাগলের মতো নিরুদ্দেশ হাঁটছিল আবীর বেলার হাত ধরে। নিশান গাড়ি নিয়ে এসে গাড়িতে উঠানোর সময়ও আবীরের খুব একটা হুঁশ নেই বললেই চলে। বেলাও সারাটা পথ আবীরের হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে। মানুষটাকে রাগ করতে দেখেছে, অভিমান করতে দেখেছে, ছেলেমানুষি-পাগলামি-তার সব ক'টা রূপই দেখেছে বেলা। তবে কখনো এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেনি। আবীরের অবস্থা দেখে বেলার নিজেরই খারাপ লাগছে। আবীরের জীবনে ও না আসলে হয়তো ছেলেটা খুশি থাকত পরিবারের সবার সাথে। সুখে থাকত। এসব ভাবতে ভাবতেই বেলার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কেন জীবনের কাছে সবাই এতো অসহায়!

নিশান ওদেরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আবীরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। আবীরও কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। নিশান চলে গেলে আবীর ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলো অনেকক্ষণ। বেলা সেই কখন থেকে ডাকছে। আবীরের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। প্রায় ঘন্টা খানেক ভিজার পর চেইঞ্জ করে রুমে এলো আবীর। আবীরকে দেখে বেলাও এগিয়ে এলো। আবীরের এলোমেলো চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে দেখে বেলা টাওয়াল হাত নিয়ে চুল মোছায় মনযোগ দিল। আবীর সব ভুলে বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। 

-কি দেখ এভাবে আবীর?

-বেলা? তুমিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

-পাগলের মতো কিসব বলছো? ছেড়ে যাব কেন?

-বিশ্বাস করো এই ব্যাপারটার কিছুই আমি জানতাম না--। জানলে সত্যিই তোমাকে নিজের সাথে কখনই জড়াতাম না--। সত্যি----।

-আবীর?

-কিন্তু এখন তুমি চলে গেলে মরে যাব একদম---। সত্যি বেলা----।

-আবীর!

বেলা আবীরের মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ স্থির করলো।

-তোমার গান শুনে-তোমার আচরণ দেখে তোমায় ভালোবেসেছি আবীর। তোমার নামের টাইটেলটাকে নয়--। আর আমার সম্পর্কেও তো সবটা জেনে ভালোবেসেছ? তবুও বাবার পরিচয় জানা নেই বলে ছেড়ে যাও নি কখনো? তবে আজ কোন আমি তোমায় ছেড়ে যাব?

আবীর বেলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। 

-আই এম সো সরি বেলা। আমি আর পারছি না এসব ভাবতে-----।

-শান্ত হও? রাত হয়েছে অনেক। একটু খেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমাও?

-বাবার পরিচয় ছাড়া কি আসলেই আমি কিছুই না বেলা? জাস্ট একটা বডি? কোন অস্তিত্ব নেই? কিচ্ছু না?

-তোমার অস্তিত্ব তোমার যোগ্যতায় আবীর। তোমার গুণ দেখে তোমার যোগ্যতার বিচার হবে আবীর। বংশ পরিচয়ে নয়। আমিও তো পরিচয় ছাড়া এতোটা পথ এসেছি আবীর। ভেঙে পড়েছি-অপমানিত হয়েছি-তবু আবার এগিয়ে গেছি সামনে। তুমিও নিজের পরিচয় তৈরি করতে পারবে আবীর। তার জন্য অন্য কারো নামের সাহায্য তোমার নিতে হবে না। তুমি চেষ্টা করো। চাকরি খোঁজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমিও সব সময় তোমার পাশে আছি- থাকবো।

বেলাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে আবীর।হালকা করে বেলার বুকে মুখ ডুবিয়ে শান্ত হয়ে চোখ বুঝেছে। বেলাও আবীরের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

-আবীর? একটু কিছু খাও প্লিজ? আমি খাবার নিচ্ছি?

-বেলা? প্লিজ খাবো না। তুমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখো।

-হুম------।

আবীরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলতো করো চুলে হাত বুলাচ্ছে বেলা। বেলার স্পর্শে আবীরও ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঘুমের জগতে হারিয়ে গেছে। আবীর ঘুমিয়ে গেছে দেখে বেলা আবীরকে ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে সায়েরার রুমে গেল। সায়েরা একটা চিঠি লিখছিল। মেয়ে এসেছে টের পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন।

-আবীর ঘুমিয়ে গেছে?

-হ্যাঁ মা---। না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।

-তুই কিছু খেয়ে-----।

-না মা---। ও কিছু খায় নি। আমি কি করে খাই? তুমি না হয় খেয়ে ঘুমাও----।

-আমি খাবো না রে মা-------।

-মা? বাবার গল্প শোনাবে আজ? খুব শুনতে ইচ্ছে করছে----।

-------------------------------

-বাবাও কি আমাদেরকে ফেলে চলে গিয়েছিল? আর ফিরে আসে নি?

-তোর বাবা ফেলে যায় নি রে---। আমিই তাকে না জানিয়েই চলে এসেছিলাম। তার বাবা যে কখনই আমাদের বিয়েটা মানতে পারে নি। তোর বাবা অবশ্য বাড়িতে বিয়ের কথাটা জানায়ও নি। দুটো বছর কি সুখেই সংসার করেছিলাম জানিস? তার সাথে আমার পরিচয়টাও হয়েছিল নাটকীয়ভাবে---। তার এক ফ্রেন্ডের বিয়ের সাক্ষী দিয়েছিলাম। অথচ তাদের কাউকেই চিনি না আমি। কলেজে যাওয়ার পথে উনি সামনে এসে হঠাৎ বললোঃ " প্লিজ আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে। একটা মেয়ে উইটনেস হওয়ার কথা ছিল-সে আসেনি। আপনি একটু তার জায়গায় সাক্ষী হয়ে চলুন।"-------এই পাগলামির কোন মানে হয় বল তো? কিভাবে কিভাবে জানি এই মানুষটার পাগলামিতে জড়িয়ে গেছি নিজেও জানি না----। দাদির পরে এই মানুষটার কাছেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছি আমি। বাবা মায়ের কথা তো মনেও নেই---। 

বেলা অবাক হয়ে সায়েরার কাছে গল্প শুনছে। বাবা মায়ের গল্প। দুটো মানুষের ভালোবাসার গল্প। এতো কিছুই সায়েরা কখনো আগে বলেনি।

Archive

Labels

অচেনা অতিথি অচেনা অতিথি (সিজন ২) অধিকার অনাকাঙ্ক্ষিত সে অন্তর্দ্বন্দ্ব অপরিচিতা মিহি অবহেলিত সম্পর্ক অবেলার অভিলাষ অস্তিত্বে তুমি অস্পষ্ট প্রেমাবেগ আড়ালে আবডালে আপনিময় তুমি আমার অন্তরালে তুমি আমার অন্তরালে তুমি (সিজন ২) আমার একটাই যে তুই আমার একটাই যে তুই (সিজন ২) আমার তুমির সন্ধানে আমার ভিনদেশি তারা আমি পদ্মজা আরশিযুগল প্রেম উপল নূড়ি উপহার উমা একটু ভালোবাসা একটুখানি কথা দিয়েছিলে ফিরবে কনফিউশন কৃষ্ণাবতী খুনী তুমি আসবে বলে তৃষ্ণা তোকে ঘিরে তোমাকে তোমাতে বিভোর ধূসর সন্ধ্যা নয়নতারা নিভৃতে যতনে নিশীথে প্রিয়তমা নীরব সাক্ষী নীল চিরকুট নীলচে তারার আলো নীলিমা পথের কাঁটা পরাণ প্রিয়া প্রিয়তা প্রেমাতাল প্রেয়সী বকুল ফুলের মালা বন্ধন বসন্তের ফুল বুকের বাঁ পাশে বৃষ্টি হয়ে নামো ভোরের রোদ মহুয়া মায়াজাল মায়াবতী মায়াবতী (সিজন ২) মেঘের খামে অনুভূতি মোবাইল পাগলী যদি তুমি জানতে যদি বলি ভালোবাসি রংধনু লাভ গেম শূণ্যতায় আমি পরিপূর্ণ শেষ থেকে শুরু শ্রাবণ মেঘের ভেলা সংসার সবুজ কাজলের কৌটো সাইকো ইজ ব্যাক সাইকো ইজ ব্যাক (সিজন ২) সাইকো ইজ ব্যাক (সিজন ৩) সাঁঝক বাতি সিঁদুর রাঙা মেঘ সুখ হঠাৎ তুমি এলে হৃদমাঝারে কে হৃদমোহিনী হৃদয়ের বন্ধন হৈমন্তীকা

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ